রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বুধবার সিপিআই ২০১৫ এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে ধানমণ্ডিস্থ টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের এই অবস্থান প্রকাশ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ উদ্বেগের কথা জানান।
টিআইবির পুরো প্রতিবেদন : বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০১৫ অনুযায়ী ২০১৪ সালের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও অবস্থানের এক ধাপ অবনতি হয়েছে। এছাড়া, বৈশ্বিক গড় স্কোরের তুলনায় বাংলাদেশের ২০১৫ সালের স্কোর অনেক কম এবং গতবারের মত একই স্কোর নিয়ে এবারও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনি¤œ হওয়ায় দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনও উদ্বেগজনক।
এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আরো কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সহ জবাবদিহিমূলক অপরাপর প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাধীনতা কার্যকরতা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। বুধবার সিপিআই ২০১৫ এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে ধানম-িস্থ টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের এই অবস্থান প্রকাশ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ বছর বাংলাদেশ ০-১০০ স্কেলে ২৫ স্কোর পেয়ে ১৬৮টি দেশের মধ্যে ঊর্ধ্বক্রম অনুসারে ১৩৯তম এবং নি¤œক্রম অনুসারে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে। ২০১৫ সালের স্কোর ২০১৪ সালের মতই অপরিবর্তিত থাকলেও অবস্থানের নি¤œক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৫ সালে এক ধাপ নিচে নেমেছে। তবে উচ্চক্রম অনুযায়ী ২০১৪ সালের তুলনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালে ছয় ধাপ এগিয়েছে।
সিপিআই অনুযায়ী ৯১ স্কোর পেয়ে ২০১৫ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক। ৯০ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড এবং ৮৯ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সুইডেন। আর সর্বনিন্ম ৮ স্কোর পেয়ে ২০১৫ সালে তালিকার সর্বনিম্নে যৌথভাবে অবস্থান করছে উত্তর কোরিয়া ও সোমালিয়া। ১১ ও ১২ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিন্মের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দেশ হিসেবে রয়েছে যথাক্রমে আফগানিস্তান ও সুদান।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “উচ্চক্রম অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ছয় ধাপ অগ্রগতি কিছুটা সন্তোষজনক মনে হতে পারে, যদিও বাস্তবে তা হয়েছে এজন্য যে, যে সাতটি দেশ এবার জরিপের আওতাভুক্ত হয়নি তারা সবসময় বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্কোর পেয়েছে। দক্ষিন এশিয়ার দেশ সমূহের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ এবার ২০১৪ সালের ১৪তম অবস্থানের একধাপ নিচে ১৩তম, যা ২০১৩ সালের তুলনায় ৩ ধাপ নিচে ও ২ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় এবারও আমাদের অগ্রগতি হলো না।”
তিনি বলেন, “যেসব কারণে আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে না, তার মধ্যে রয়েছে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কিছু কিছু দুর্নীতি বিরোধী উদ্যোগ স্বত্ত্বেও প্রয়োগ ও চর্চার ঘাটতির ফলে প্রকটতর হয়েছে কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনের দৃষ্টান্তের সংকট। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দুদকের কার্যকরতা ও স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস যেমন অব্যাহত রয়েছে তেমনি দুদকের নিজস্ব সক্রিয়তা, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতার ঘাটতি রয়েছে চলমান। এছাড়াও সরকারের নীতি কাঠামো দুর্নীতি সহায়ক, দুর্নীতিতে লাভবান ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয়দানকারী মহলের করাভূত হওয়ার ঝুঁকির সম্মুখিন হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতির তথ্য তুলে ধরে জানানো হয় যে, ২০১৫ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বৈশ্বিকভাবেই অবস্থার অবনতি হয়েছে। সূচকে কোন দেশই শতভাগ স্কোর পায় নি। বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নত দেশসমূহের অনেকেই, যেমন অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, জাপান, অষ্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালী ইত্যাদি ৮০ শতাংশের কম স্কোর পেয়েছে। ১৬৮টি দেশের মধ্যে ১১৪টি, অর্থাৎ ৬৮ ভাগ দেশ ৫০ এর কম স্কোর পেয়েছে। ১০৩টি দেশ সূচকের গড় স্কোর ৪৩ এর চেয়ে কম পেয়েছে। এছাড়াও ২০১৪ সালে যেখানে ৯২টি দেশের স্কোর বেড়েছিল, ২০১৫ সালে সেখানে ৬৫টি দেশের স্কোর বেড়েছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ৩৬টির তুলনায় ২০১৫ সালে ৪৯টি দেশের স্কোরে অবনতি হয়েছে। উদাহরনস্বরূপ, ডেনমার্ক গতবার ৯২ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকার শীর্ষে থাকলেও এবার তাদের স্কোর ৯১। এছাড়া নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, লুক্সেমবার্গ ও সিঙ্গাপুরের মত দেশের স্কোরেও অবনতি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় যে, সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে বাংলাদেশ বা তার অধিবাসীদের দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করা হয়। বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না বলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা অভিমত প্রকাশ করেন। দুর্নীতি প্রতিরোধে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি ড. জামান বলেন বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতির প্রশ্রয়কারীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তির বিধান করা গেলে দুর্নীতি অনেক কমে আসবে।”
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয় যে, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবি’র গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআই-এ প্রেরণ করা হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতই টিআইবি’ও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র। উল্লেখ্য, এবছর বাংলাদেশের সাথে একই স্কোর প্রাপ্ত অন্য পাঁচটি দেশ হল: গিনি, লাওস, কেনিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি ও উগান্ডা।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি এম. হাফিজউদ্দিন খান ও উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “সিপিআই র্যাংকিংয়ে আমাদের স্কোর গতবারের চেয়ে কমে না যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও আমাদের কিন্তু বসে থাকলে চলবে না। কারণ আমরা এখনও গড় যে স্কোর তার কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারি নি। তাছাড়া সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন হলেও উন্নয়নের সাথে আমাদের দেখতে হবে যে দুর্নীতি কমছে কিনা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা। গণতন্ত্রের বিনিময়ে উন্নয়ন কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা নিয়েও ভাবার অবকাশ রয়েছে।”
এছাড়া টিআইবি’র ট্রাস্টি এম. হাফিজউদ্দিন খান বলেন, “যদি সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর হয়, প্রশাসনযন্ত্র সংসদের জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে, বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে আমাদের অবস্থার আরো উন্নতি হতে পারে।”
সিপিআই সূচকে স্কেলের ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণার মাপকাঠিতে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত দেশ বলে ধারণা করা হয়। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের সিপিআই-এ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে আগস্ট ২০১৫ পর্যন্ত সময়ের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। সিপিআই ২০১৫ এর জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সূত্র হিসেবে সাতটি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে।
জরিপগুলো হলো: বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট ২০১৪, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিউকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে ২০১৫, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স ২০১৬, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট ‘রুল অব ল’ ইনডেক্স ২০১৫, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড ২০১৫, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্ ২০১৫ এবং গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্ ২০১৪ এর রিপোর্ট।
বৈশ্বিক দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও অ-ব্যবস্থাপনার বিষয়ে টিআইবির অভিযোগ মেনে নিয়েছেন তিনি।
বুধবার সচিবালয়ে ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে টিআইবি’র প্রতিবেদনের বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘(দুর্নীতিতে) কোনো ইম্প্রুভমেন্ট হয়নি বলে আমার ধারণা। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি কথাও বলতে চাই না। দুর্নীতির ব্যপারটাতে আমরা টাচ-ই করতে পারি নাই।’
দুর্নীতি কমাতে ডিজিটালাইজেশনের উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের পদক্ষেপ আছে। আমার ইনিশিয়েটিভ কন্টিনিউয়িং ডিজিটালাইজেশন।’ এ সময় তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সিলেটের মদন মোহন কলেজ ডিজিটালাইজেশন হওয়ায় আয়ের পরিমান ৮ লাখ টাকা থেকে ৮২ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে।’
‘আর্থিক খাতের কারণে দুর্নীতির সূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি নেই’ বলে টিআইবি’র পর্যবেক্ষণের বিষয়ে মুহিত বলেন, ‘হ্যাঁ সেটা হতে পারে’।
তবে তিনি এটাও বলেন যে, ‘হলমার্কসহ বিভিন্ন ঘটনায় সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে তা-ও বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর্থিক খাতের কয়েকটি কেলেঙ্কারির কারণে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পর্যায়ের কাউকে এর আগে আইনের আওতায় আনা হয়নি। একটি ব্যংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির মাত্রা প্রকাশ করে। বুধবার সকালে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫সালে বিশ্বের ১৬৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। এর আগের বছর ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম। সূত্র : বিজ্ঞপ্তি